"রোদ্দুরে ভেজা চিঠি"
ছোট্ট, সবুজে মোড়া চড়কপুর গ্রামের সকালের রোদ যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। পুরনো বটগাছের ডালে বসে পাখিরা কিচিরমিচির করে, আর বুনো ফুলের গন্ধে বাতাস ম-ম করে। এই গ্রামের বুকে, নীল আকাশের নিচে, দু’টি প্রাণ থাকত—তুলি আর আরিফ। তারা যেন আগুন আর জল, কিন্তু পাশাপাশি থাকা দুটি নক্ষত্রের মতো।
তুলি ছিল হাসিখুশি, তার হাসির শব্দ ধানক্ষেতের শেষ সীমানা পর্যন্ত পৌঁছে যেত। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করত সে, আর বিকেলে মায়ের সাথে সেলাইয়ের কাজ করত। তার স্বপ্ন ছিল গ্রাম পেরিয়ে অনেক দূরে যাওয়ার। অন্যদিকে আরিফ ছিল একেবারে শান্ত, নিরিবিলি স্বভাবের। সে তার বাবার সাথে মাঠে কাজ করত। নিজের জীবন আর গ্রামের সহজ-সরল জীবনটাই তার কাছে ছিল সব।
ছোটবেলা থেকেই তারা একে অপরকে চিনত, কিন্তু কথা তেমন হয়নি। এক বর্ষার দুপুরে তাদের দু'জনের পথ প্রথমবারের মতো এক হয়। তুলি এক ঝুড়ি আম নিয়ে ফিরছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই পিচ্ছিল মাটিতে পিছলে পড়তে যাচ্ছিল। আরিফ তাকে ধরে ফেলল, তার পড়ে যাওয়ার আগেই।
তাদের চোখে চোখ পড়ল, আর সেই মুহূর্তেই যেন একে অপরকে কিছু না বলেও সব কথা বলে ফেলল।
এরপর থেকে দু’জনের দেখা হতে থাকল গ্রামের পথে, খেজুর গাছের তলায়, কখনোবা নদীর ধারে। দু’জনেই চুপচাপ, কিন্তু চোখের ভাষায় যেন তারা একে অপরের সব কথা বুঝে নিত। তারা জানত, কেউ কাউকে কিছু বলবে না, কিন্তু এই নীরবতা তাদের ভালোবাসার এক বিশেষ রূপ।
তুলি রোজ বিকেলে নদীর ধারে বসে থাকত, আর আরিফ দূর থেকে তাকে দেখত। একদিন আরিফ সাহস করে তুলি কে একটি চিঠি দিলো, তাতে লেখা ছিল – "তোমার মুখে রোদের হাসি, সেই হাসির দিকে তাকিয়ে আমি আমার মন হারিয়ে ফেলেছি। যদি তোমারও এই মনোভাব থাকে, তাহলে আগামী বিকেলে নদীর ধারে দেখা করো।"
তুলির মুখে লাজুক হাসি খেলে গেল। পরের দিন, বিকেলে নদীর ধারে তুলি দাঁড়িয়ে ছিল। আরিফ আসতে দেরি করল না। তারা অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। কিছুই বলল না, কিন্তু মন যেন একে অপরের কাছে খুলে দিল। সেই সন্ধ্যায়, অস্তগামী সূর্যের আলোয় দুজনের ছায়া মিশে গেল, আর তারা জানল যে তারা জীবনের সব পথ একসাথে পাড়ি দেবে।
তাদের ভালোবাসা ছিল নীরব কিন্তু গভীর। জীবনের নানা ঝড়-ঝাপটা তাদের কাছে আসে, কিন্তু একে অপরের হাত ছাড়েনি। যেমন রোদ্দুর ভেজা চিঠিতে লেখা কথা কখনো হারিয়ে যায় না, তেমনই তাদের ভালোবাসা গ্রাম জুড়ে অমলিন হয়ে রইল।
©2024, Easy Tech Solution
0 Comments